রাসায়নিক বন্ধন : আয়নিক বন্ধন

রাসায়নিক বন্ধনঃ আয়নিক বন্ধন: রাসায়নিক সম্পর্কে ভাল ধারণা পেতে রাসায়নিক বন্ধন নিয়ে বিস্তারিত জানা আবশ্যক। রাসায়নিক বন্ধন হচ্ছে একাধিক মৌল বা যৌগ কীভাবে পরস্পর যুক্ত হয়ে নতুন যৌগ গঠন করে সে সম্পর্কিত আলোচনা। রাসায়নিক বন্ধন কেবল মৌল বা যৌগগুলোর মধ্যে নয়, আয়নসমূহের মাঝেও রাসায়নিক বন্ধন থাকতে পারে। রাসায়নিক বন্ধন ছাড়া কোন রাসায়নিক পদার্থ গঠন হওয়া সম্ভব নয়।

রাসায়নিক বন্ধন : আয়নিক বন্ধন

রাসায়নিক বন্ধন কতটা শক্তিশালী বা স্থায়ী, তাঁর উপর ভিত্তি করে একে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হলো প্রাইমারি বন্ড এবং অপরটি সেকেন্ডারি বন্ড। প্রাইমারি বন্ড হচ্ছে শক্তিশালী বন্ধন আর সেকেন্ডারি বন্ড হচ্ছে অপেক্ষাকৃত দুর্বল বন্ধন। প্রাইমারি বন্ধনের মাঝে আমরা প্রধান ও পরিচিত তিনটি রাসায়নিক বন্ধন আয়নিক বন্ধন (Ionic Bond), সমযোজী বন্ধন (Covalent Bond) এবং ধাতব বন্ধন (Metallic Bond) কে দেখতে পাব ; আর সেকেন্ডারি বন্ধনের উদাহরণ হিসেবে ডাইপোল-ডাইপোল আকর্ষণ কিংবা হাইড্রোজেন বন্ধন এর কথা বলা যেতে পারে।

[ রাসায়নিক বন্ধন : আয়নিক বন্ধন ]

যদিও সকল রাসায়নিক বন্ধনকে কোয়ান্টাম থিওরি দিয়ে বর্ণনা করা যায়, তবুও মৌলসমূহের অরবিট এর স্থিতিশীলতার নীতি এবং VSEPR থিওরি (Valence shell electron pair repulsion) দিয়ে বন্ধনসমূহকে বর্ণনা করা হয়ে থাকে এবং এটিই বহুল প্রচলিত ও পরিচিত।

VSEPR থিওরি হলো মৌলগুলোর সর্বশেষ শক্তিস্তর বা যোজনী স্তরের ইলেক্ট্রন যুগল এর রিপালশন থিওরি। এটিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের অরবিট এবং অরবিটাল নিয়ে কিছু কথা বলতে হবে।

পর্যায় সারণির কোন একটি মৌল, ধরা যাক সোডিয়াম (Na) । সোডিয়ামের ইলেক্ট্রন সংখ্যা ১১, এবং এর পারমানবিক সংখ্যাও ১১ । কোন মৌলের নিউক্লিয়াসে অবস্থিত এর মোট প্রোটন সংখ্যাকে ঐ মৌলের পারমানবিক সংখ্যা বলে। প্রোটন পজিটিভ (+) চার্জযুক্ত হয় আর ইলেকট্রন নিগেটিভ (-) চার্জযুক্ত হয়। পরমানুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াসে যদিও নিউট্রন নামক কণিকা থাকে, কিন্তু নিউট্রনের কোন চার্জ থাকে না। একটি পরমানু যেন চার্জ প্রদর্শন করতে না পারে এবং নিউট্রাল চার্জ প্রদর্শন করে, সেজন্য এর ভেতরের ইলেকট্রন এবং প্রোটন সংখ্যা সবসময় সমান থাকে। যদি একই মৌলের একাধিক নিউট্রন সংখ্যাযুক্ত পরমাণু দেখতে পাওয়া যায়, তখন তাদেরকে ঐ মৌলের আইসোটোপ (Isotope) বলা হয়। এই অসম নিউট্রনযুক্ত নিউক্লিয়াস পরমাণুর চার্জের বা বন্ধন বিষয়ক কোন ধর্মের পরিবর্তন করে না।

যাই হোক, সোডিয়ামের সাথে আরেকটি মৌল নিয়ে এদের যৌগ গঠন ব্যাখ্যা করে আমরা রাসায়নিক বন্ধন বোঝার চেষ্টা করব। সোডিয়াম (Na-11) এবং আরেকটি মৌল ক্লোরিন (Cl-17) এর মধ্যে যৌগ গঠন হয়ে সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) গঠিত হয়, যা আমাদের সবার কাছে খাবার লবণ হিসেবে পরিচিত। এবং এই বন্ধনের নাম আয়নিক বন্ধন (Ionic Bond) । আয়নিক বন্ধন ব্যাখ্যা করতে গেলে নিষ্ক্রিয় মৌল বুঝতে পারা জরুরী।

তার আগে নিচের চিত্রটি থেকে আয়নিক বন্ধন সম্পর্কে একটি ধারণা নেওয়া যাক। দেখা যাচ্ছে Na এর প্রথম শক্তিস্তরে দুইটি ইলেক্ট্রন আছে, দ্বিতীয় শক্তিস্তরে আটটি ইলেক্ট্রন ও সর্বশেষ শক্তিস্তরে একটি ইলেক্ট্রন রয়েছে। Cl এর ক্ষেত্রে প্রথম শক্তিস্তরে দুইটি ইলেক্ট্রন আছে, দ্বিতীয় শক্তিস্তরে আটটি ইলেক্ট্রন ও সর্বশেষ শক্তিস্তরে ইলেক্ট্রন রয়েছে মোট সাতটি। বলে রাখা ভাল, মৌলগুলোর নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেক্ট্রনগুলো ঘুরতে থাকে এবং এই ঘোরার পথটি কক্ষপথ বা শক্তিস্তর নামে পরিচিত। বন্ধন গঠনের সময় কেবল সর্বশেষ শক্তিস্তরের মধ্যে ইলেক্ট্রন আদান প্রদান বা দান ও গ্রহণ হয়। আয়নিক বন্ধনের ক্ষেত্রে ইলেকট্রন আদান প্রদান হলেও সমযোজী বা Covalent Bond এর ক্ষেত্রে ইলেকট্রন শেয়ার ঘটে, সেটিও সর্বশেষ শক্তিস্তরেই।

আবার চিত্রটিতে ফিরে আসা যাক। উপরের চিত্রে শুরুতেই দেখা যাচ্ছে, Na তার শেষ শক্তিস্তর থেকে একটি ইলেক্ট্রন ক্লোরিনের শেষ শক্তিস্তরে দিয়ে দিচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন দিচ্ছে? এবং কেনই বা Cl তার সাতটি ইলেক্ট্রন Na কে না দিয়ে নিজে একটি ইলেক্ট্রন নিচ্ছে?

দেখা যাচ্ছে, Na একটি ইলেকট্রন দিয়ে Na+ এবং Cl সেই একটি ইলেক্ট্রন নিয়ে Cl আয়ন গঠন করেছে। এই দুইটি একক অথচ বিপরীত চার্জের আয়ন পরস্পরকে আকর্ষণ করছে এবং একত্রিত হয়ে সোডিয়াম ক্লোরাইড (NaCl) যৌগ গঠন করছে। এভাবে ইলেকট্রন দান এবং গ্রহণের মাধ্যমে বন্ধন গঠন করার প্রক্রিয়াকে আয়নিক বন্ধন বলে, কেননা এখানে বন্ধন গঠিত হয়েছে দুটি আয়নের মধ্যে এবং তারা আয়ন হয়েছে ইলেক্ট্রন দান এবং গ্রহণ করার
মাধ্যমে।

এখন প্রশ্নে ফিরে আসা যাক। প্রশ্নের উত্তর পেতে নিচের ১ ও ২ মার্ক করা চিত্র দুইটি ভাল করে দেখতে হবে।

চিত্র-১

 

চিত্র-২
চিত্র-২

প্রথম চিত্রে নিষ্ক্রিয় মৌল বা Inert Gases/ Noble gases এর ইলেক্ট্রন বিন্যাস দেখানো হয়েছে। হিলিয়ামের মাত্র দুইটি ইলেক্ট্রন থাকায় তার শেষ শক্তিস্তরে দুইটি বা একমাত্র শক্তিস্তরে দুইটি ইলেক্ট্রনই রয়েছে এবং সে এভাবে স্থিতিশীল আছে। অর্থাৎ, খুব সহজে সে কোন বিক্রিয়া করবে না। পরের প্রতিটি মৌলের শেষ অরবিটে আটটি করে ইলেকট্রন আছে। এরা সবাই স্থিতিশীল মৌল এবং এভাবে আটটি ইলেকট্রন শেষ অরবিটে রেখে স্থিতিশীল হওয়াকে অষ্টকের নিয়ম বা Octate Rule বলে।
২ নং চিত্রে নিষ্ক্রিয় মৌলগুলোর পর্যায় সারণিতে অবস্থান দেখানো হয়েছে এবং দেখা যাচ্ছে মোট ১৮ টি পিলার সদৃশ গ্রুপের মাঝে সব নোবেল গ্যাস গ্রুপ ১৮ তে অবস্থান করছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, পর্যায় সারণির সকল মৌল নিজেদের ইলেক্ট্রন দান-গ্রহণ অথবা শেয়ারের মাধ্যমে যে করেই হোক, নোবেল গ্যাসের সর্বশেষ শক্তিস্তরের ইলেকট্রন বিন্যাসের রূপে যেয়ে স্থিতিশীল হতে চায়। Na+ ও Cl- এর সর্বশেষ শক্তিস্তর s2 P6 আকার ধারণ করেছে যা Na এর ক্ষেত্রে Ne এর মত ও Cl এর জন্য Ar এর মত। এক্ষেত্রে পর্যায় সারণিতে যে মৌলের কাছাকাছি যে নিষ্ক্রিয় মৌল রয়েছে, যৌগ গঠনের সময় সেটি তার মত হতে চায়। আরেকটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, কম ইলেকট্রন দান বা গ্রহণ করা সহজ।

আয়নিক বন্ধন নিয়ে ChemicalGOLN এ পরবর্তীতে আরো বিস্তারিত লেখা হবে। সমযোজী বন্ধন নিয়ে ChemicalGOLN এ এর পরবর্তী নিবন্ধটি পড়তে পারেন। আর এই আর্টিকেলের ইলেকট্রন বিন্যাস সম্পর্কিত ব্যাখ্যাগুলোর জন্য ChemistryGOLN.com এর মৌলসমূহের ইলেক্ট্রন বিন্যাস আর্টিকেলটি সহায়ক হবে।

আরও পড়ুন:

Leave a Comment